হেফাজতে ইসলাম শুরু থেকেই বলে আসছে তারা কোন রাজনৈতিক দল নয়, ক্ষমতায় যাওয়ার কোন উদ্দেশ্য তাদের নেই। এই দৃষ্টিকোন থেকে বলা চলে হেফাজত রাজনৈতিক দল নয়। আবার বর্তমান সরকারকে ক্ষমতা থেকে ছুড়ে ফেলে দেয়ার হুমকিও দিয়েছে কয়েকবার। এরা ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকা ঢোকার পথ দখল করে নিয়ে, মতিঝিলে এসে তান্ডব চালিয়ে তাদের শক্তির প্রদর্শন করে। সেই সময়ে শাপলা চত্বরে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মসূচি চলছিল। তারা যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতের দাবি করেছিল। এই সময়ে হেফাজতের কর্মসূচি নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন গণজাগরণ মঞ্চের দাবিকে নস্যাৎ করার লক্ষ্যে এই কর্মসূচি নয়তো?

অরাজনৈতিক দল এই আড়াল নিয়ে তারা জনগণের দৃষ্টি ফেরাতে পেরেছিল। ঐ ঘটনায় হেফাজতের দাবি ছিল তাদের আড়াই থেকে তিন হাজার নেতা কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। তৎকালীণ পুলিশ প্রধান চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেছিলেন, একজন লোককেও মারা হয়নি। তিনি হেফাজতকে নিহতের তালিকা দিতে বলেছিলেন। হেফাজত ৬১ জনের একটি তালিকা তৈরী করে সরকারকে না দিয়ে ‘অধিকার’ নামের একটি সংগঠনকে দেয়। সেই সংগঠনটি তালিকা দেখে আর তা সরকারকে জমা না দিয়ে হেফাজতকে অনুরোধ করে তারা যেন বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করে। হেফাজত আর এগোয়নি। আমরা জানি সংগঠনের একজন নেতা বা কর্মী মারা গেলে সেই সংগঠন আন্দোলন আরো তীব্রতর করে। হেফাজতের এই পিছিয়ে যাওয়া থেকে অনুমান করা যায় হেফাজতের দাবি সঠিক ছিল না।

২০১৭ সালে হাইকোর্টের সামনে স্থাপিত একটি ভাষ্কর্য নিয়ে আবারো মাঠে নামে হেফাজত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাদের পক্ষ নিয়ে ভাষ্কর্যটি হাইকোর্টের পিছনে নিয়ে যেতে অনুরোধ করলে হাইকোর্ট প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধ রক্ষা করে তা পিছনে স্থাপন করে। এবছরই হেফাজতের অনুরোধে প্রাথমিক শিক্ষার বইগুলোতে ২৯টি লেখায় সংযোজন ও বিয়োজন ঘটায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে ব্লাসফেমি আইন, নাস্তিক ব্লগারদের শাস্তি দেয়া, উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ধর্মীয় শিক্ষাকে বাধ্যতামুলক করা, কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণার হেফাজতি দাবি মানেনি সরকার। একই সাথে কওমী মাদ্রাসার সর্বোচ্চ ডিগ্রি ‘দাওয়াওে হাদিস’কে মাস্টার্স ডিগ্রির মর্যাদা দেয় সরকার।

১৯৯০ সাল থেকে কওমী মাদ্রাসাগুলো এই দাবি করে আসছিল। সরকার ও হেফাজতের আপোষ দৃশ্যমান হয়। এরপর আশা করা হয়েছিল সরকার কওমী মাদ্রাসার শিক্ষা ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ নিবেন। সেখানেও কওমী মাদ্রাসাগুলো বাধ সাধে। সরকার এই বিষয়ে একটি কার্যক্রম হাতে নিলেও তা মুখ থুবরে পড়ে আছে।

২০২১ সালে এসে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সফরকে কেন্দ্র করে হেফাজত আবার মাঠে নামে। ২৬ মার্চ থেকে ২৮ মার্চ হাটহাজারী ও ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ায় তারা তান্ডব চালিয়ে পুলিশ ফাড়িসহ সরকারি বেসরকারি ৩৮টি স্থাপনা ধ্বংস করে। এর মাঝে আছে বাঙালি সংষ্কৃতি লালনকারী ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’র নামে প্রতিষ্ঠিত দুটি সংগঠনের কার্যালয় ও ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নামে প্রতিষ্ঠিত একটি চত্তর। ধীরেন্দ্র দত্ত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে সেই ৪৭ সালে বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার প্রস্তাব তুলেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন। এর আগে বঙ্গবন্ধুর ভাষ্কর্য ভাঙ্গার অভিযোগও আছে তাদের বিরুদ্ধে। এইসব ঘটনা পরিষ্কার ইঙ্গিত দেয় হেফাজত, ইসলামের নামে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী বিভিন্ন সংগঠনের একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফরম।

এই দলে বিভিন্ন ইসলামী সংগঠনের যেমন খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, খেলাফত আন্দোলন, নেজামে ইসলাম, ইসলামি ঐক্য জোটের মতো নিবন্ধিত দলের বড় বড় নেতারা আছেন। এছাড়া অনেক অনিবন্ধিত ইসলামি দলের নেতারাও আছেন। জামাতে ইসলামের নিবন্ধন নেই। তারাও এই সংগঠনের মাধ্যমে তাদের কাজ চালাবেন এটা স্বাভাবিক। ইতোমধ্যেই শিবিরের প্রাক্তন নেতা এই সংগঠনের উচ্চ পর্যায়ে আছেন বলে প্রমাণিত হয়েছে। এসব ইসলামি দল আবার বিএনপিপন্থী ও আওয়ামী লীগপন্থীতে বিভক্ত বলে জানা যায়।

আল্লামা শফির আমলে দলে আওয়ামীপন্থীদের শক্তি বেশি ছিল, কিন্তু তাতে লাভ কি হয়েছিল? ২০১৩ ও ১৭ সালে আল্লামা শফি সাহেবই তো নেতা ছিলেন। এখন নেতা হয়েছেন বাবু নগরী। তিনি কট্টর আওয়ামী লীগ বিরোধী। যে পন্থীই হোন না কেন এইসব ইসলামী দলের মূল চরিত্র একটিই – তা হলো ইসলামের নামে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধিতা করা।

উল্লেখ্য মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আলেম উলেমাদের একটি অংশ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভূমিকা রেখেছিল। তারা ইসলামের অন্যতম নীতি অসাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাসী ছিল। অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধের সময় নামাজ পড়েছে, রোজা রেখেছে। মুক্তিযোদ্ধারা ইসলামের সাথে মুক্তিযুদ্ধের কোন বিরোধ দেখেননি। বর্তমানের অনেক ইসলামি দল মুক্তিযুদ্ধের সাথে ইসলামের একটি কল্পিত বিরোধ সৃষ্টি করেছে। তারা সবাই মিলে হেফাজতের প্ল্যাটফরমকে ব্যবহার করছে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী কর্মকান্ডকে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য।

আবার এইদলগুলো ইসলামকে নিজের মতো করে ব্যাখ্যা দিচ্ছে যেমন দিয়েছিল পাকিস্তানি শাসকরা। ৪৭-৪৮ সালে তারা উর্দুকে মুসলমানদের ভাষা বলে দাবি করেছিল। এখনকার ইসলামি দলগুলোর অনেকেই এখন ভাষ্কর্যকে ইসলাম বিরোধী বলে আখ্যায়িত করছে। অনেকেই পরোক্ষভাবে এবং অনেকেই প্রত্যক্ষভাবে বাঙালি সংষ্কৃতির বিরোধিতা করছে যা ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার ঘটনায় প্রমাণিত।

প্রশ্ন হলো হেফাজতকে ব্যবহার কেন? হেফাজত মূলত কওমী মাদ্রাসা ভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান। দেশে প্রায় ৪০ হাজার কওমী মাদ্রাসা আছে এবং ৪০ লক্ষ ছাত্র-ছাত্রী আছে। এই ছাত্রদের কিছু সংখ্যক ছাড়া সবাই তাদের শিক্ষকদের প্রতি পুরোপুরি অনুগত। প্রিন্সিপাল এবং শিক্ষক বললে এই ছাত্ররা যে কোন কাজ করতে পিছপা হয় না। প্রমাণ পাওয়া গেছে ২০১৩ সালের শাপলা চত্তরে। ১২/১৩ বছরের হাজার হাজার ছেলে সেখানে গিয়েছিল। যেখানেই হেফাজতের কর্মসূচি সেখানেই কিশোর নিরীহ ছাত্রদের ভীড়। এই সময়ে ২/৩ লাখ লোকের সমাবেশ ঘটানো কোন রাজনৈতিক দলের পক্ষে যেখানে সম্ভব নয়, সেখানে হেফাজতের পক্ষে সম্ভব এই কারণে। এই বিশাল সমাবেশকে ব্যবহার করে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী অনেক দল মুক্তিযুদ্ধের সকল অজর্নের বিরুদ্ধে কাজ করে, সন্ত্রাস করে।

বলা হয়, কওমী মাদ্রাসা চলে জনগণের টাকায়। আসল কথা হলো সবাই যে স্বেচ্ছায় টাকা দেন তা নয়। নিরীহ ছেলেদের দিয়ে চাঁদার নামে টাকা তোলা হয়। আর নেতাদের টাকার সংবাদতো এখন বের হচ্ছে। বহুদিন পরে হলেও সরকার এখন হেফাজতের সন্ত্রাসবাদী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। নেতাদের টাকার সূত্র ও ব্যক্তি একাউন্টে জমানো টাকার পরিমান বের করার উদ্যোগ নিয়েছে। এক বড় নেতার পাকিস্তানি সংযোগও বের হয়েছে। সুষ্ট ও নিবিড় তদন্তে আরো ভয়াবহ অনেক সত্য বেরিয়ে আসবে বলে অনেকের বিশ্বাস।

ইতোমধ্যে সংগঠন হিসেবে হেফাজতের মিথ্যাচারের সংবাদ, তাদের নৈতিক অধপতনের সংবাদ এবং তাকে ইসলামি ব্যাখ্যা দিয়ে আড়াল করার সংবাদ দেশবাসী জেনেছে। আশা করা যায়, সরকার সব সত্য উদঘাটন করে হেফাজত ও তার নেতাদের স্বরূপ জনগণের কাছে, কওমী ছাত্রদের কাছে উম্মোচন করবে। এরপর যথাযথ আইনী পদক্ষেপ নিবে। হেফাজতকে নিষিদ্ধ করে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী সন্ত্রাসবাদীদের কমন প্ল্যাটফরমটি ধ্বংস করে দিবে এটাই জনপ্রত্যাশা।

একই সাথে কওমী মাদ্রাসাগুলো সরকারি কর্তৃত্বে নিয়ে তাকে কর্মমুখী শিক্ষার অধীনে এনে লক্ষ লক্ষ কওমী ছাত্রদের ভবিষ্যতে আত্মনির্ভরশীল করার কর্মসূচি নিবে এটাই সবার প্রত্যাশা। তবে সংবিধান মেনে একমুখী গণমুখী বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার প্রচলনই হলো সমস্যার আসল সমাধান। সরকারকে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে বৈকি।